কী কী ধরনের প্রায়োগিক লেখার সঙ্গে তুমি পরিচিত হয়েছ, সেগুলোর একটি তালিকা তৈরি করো। লেখার পরে সহপাঠীর সঙ্গে আলোচনা করো এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো।
প্রয়োগিক লেখার ধরন | এ ধরনের লেখা কী কাজে লাগে |
---|---|
প্রায়োগিক লেখা: সংবাদ প্রতিবেদন
নমুনা ১
১৯শে ডিসেম্বর ২০২৩, সাতক্ষীরা। নিজস্ব প্রতিনিধি।
ফলের গাছ লাগিয়ে সফল হয়েছেন সাতক্ষীরার তালা উপজেলার যুবক হাবিবুর রহমান। দুই একর জমির উপর তিনি দশ-বারো রকমের ফলের গাছ লাগিয়েছেন। গত বছর ফলের বাগান থেকে তিনি প্রায় দেড় লাখ টাকার ফল বিক্রি করেন।
হাবিবুর রহমান একজন উচ্চশিক্ষিত তরুন। শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি চাকরির পিছনে ছোটেননি; বরং পারিবারিক এক একর জমির সঙ্গে আরও এক একর জমি ইজারা নিয়ে চার বছর আগে ফলের বাগান করা শুরু করেন। সরেজমিনে তালা উপজেলায় গিয়ে দেখা যায়, হাবিবুর রহমান ১০০টি বিভিন্ন জাতের আম গাছ, ২০০টি লেবু গাছ, ১৫০টি পেয়ারা গাছ, ১৫০টি পেঁপে গাছ এবং ১০০টি আমড়া গাছ লাগিয়েছেন। এর বাইরেও কিছু লিচু গাছ, চালতা গাছ, জামরুল গাছ এবং সফেদা গাছ আছে। এ বছর তিনি আম বিক্রি করে ৫০ হাজার টাকা, লেবু বিক্রি করে ২০ হাজার টাকা, পেয়ারা থেকে ১০ হাজার টাকা, পেঁপে থেকে ২০ হাজার টাকা হাবিবুর রহমানের সফলতা দেখে এলাকার অনেকেই এখন ফলের গাছ লাগানোর ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। একই উপজেলায় অন্তত তিন জন গত এক বছরের মধ্যে নতুন করে ফলের গাছ রোপন করেছেন। হাবিবুর রহমানের ছোটো ভাইও পড়াশোনার পাশাপাশি বড়ো ভাইয়ের কাজে সহায়তা করছেন। নতুন চারাগাছ লাগানো, কীটনাশক ছিটানো, ফল তোলা-এসব কাজে সহায়তা নেওয়ার জন্য হাবিবুর রহমানের বাগানে অতিরিক্ত দুই জন লোক কাজ করেন। সামনের দিনগুলোতে তিনি আরো কিছু জমি ইজারা নিয়ে বাগান বড়ো করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। প্রতিদিনই কোনো না কোনো লোক হাবিবুরের বাগান দেখতে আসছেন এবং তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন।
নমুনা ২
মনীষা তঞ্চঙ্গ্যা, বান্দরবান, ২৯শে জানুয়ারি ২০২৪
বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার বালুটিলা উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গত ২৮শে জানুয়ারি ২০২৪ রবিবার বিদ্যালয়ের নতুন শিক্ষার্থীদের জন্য নবীন-বরণ এবং এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বালুটিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি উদয় কুমার চাকমা। তিনি বলেন, এই এলাকার ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য বিদ্যালয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। নবীন শিক্ষার্থীদের তিনি মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করার আহ্বান জানান এবং ২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের সফলতা কামনা করেন।
এ বছর বিদ্যালয়টির মানবিক শাখা থেকে ৫০ জন, বিজ্ঞান শাখা থেকে ৪০ জন এবং ব্যবসায় শিক্ষা শাখা থেকে ২৫ জনসহ সর্বমোট ১১৫ জন পরীক্ষার্থী আগামী ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হতে যাওয়া এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। বালুটিলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অজয় ত্রিপুরা এই নবীন-বরণ ও বিদায়- সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠানে অন্যান্য ব্যক্তির মধ্যে বক্তৃতা করেন বিশিষ্ট সমাজকর্মী ললিত বিশ্বাস, বালুটিলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুহিতুল আলম প্রমুখ। অনুষ্ঠানে অনেক শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষার্থীদের মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে এ দিনের সাড়ম্বর আয়োজন সমাপ্ত হয়।
উপরের দুটি নমুনা রচনার ভিত্তিতে নিচে কয়েকটি প্রশ্ন দেওয়া আছে। তোমার সহপাঠীর সঙ্গে প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনা করো, সংক্ষেপে এগুলোর উত্তর তৈরি করো এবং উপস্থাপন করো। উপস্থাপনের পরে শিক্ষকের পরামর্শ অনুযায়ী সংশোধন করো।
ক. এ ধরনের লেখা কোথায় দেখা যায়?
__________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
খ. এ ধরনের লেখার উদ্দেশ্য কী?
__________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
গ. এসব লেখাকে প্রায়োগিক লেখা বলা হয় কেন?
__________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
ঘ. সংবাদ প্রতিবেদনে কী কী থাকা আবশ্যিক বলে তুমি মনে করো?
__________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
সংবাদ প্রতিবেদন
প্রচারমাধ্যমে প্রচারের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সংবলিত বিবরণীকে সংবাদ প্রতিবেদন বলে। যিনি এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন, তাঁকে প্রতিবেদক বলে। প্রতিবেদককে গভীর মনোযোগের সঙ্গে ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে হয় এবং ঘটনার পক্ষপাতহীন বিবরণ তৈরি করতে হয়।
সংবাদ প্রতিবেদনের শুরুতে একটি শিরোনাম থাকে। এরপর প্রতিবেদকের নাম, ঘটনার স্থান ও তারিখ উল্লেখ করতে হয়
নিচে কিছু বিষয় দেওয়া হলো। এগুলোর মধ্য থেকে যে কোনো বিষয়ের উপর ১৫০-২০০ শব্দের একটি প্রতিবেদন তৈরি করে 'আমার বাংলা খাতা'য় লেখো। লেখা হয়ে গেলে শ্রেণির অন্য শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করো।
নানা ধরনের বিবরণমূলক রচনার সঙ্গে তোমাদের পরিচয় আছে। একেক ধরনের রচনায় একেক ধরনের বিবরণ থাকে। কোন ধরনের রচনায় কী ধরনের বিবরণ প্রত্যাশা করা হয়, তার একটি তালিকা করো। প্রথমটি তৈরি করে দেওয়া হলো। লেখার পরে সহপাঠীর সঙ্গে আলোচনা করো এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো।
মুহম্মদ আবদুল হাই (১৯১৯-১৯৬৯) একজন ভাষাবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক। তাঁর বিখ্যাত একটি বইয়ের নাম 'ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব'। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে আছে 'সাহিত্য ও সংস্কৃতি', 'তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা', 'ভাষা ও সাহিত্য' ইত্যাদি। নিচের লেখাটি লেখকের 'বিলেতে সাড়ে সাতশো দিন' গ্রন্থের অংশবিশেষ। এ রচনাটি লেখকের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতার বিবরণ।
রচনাটি নীরবে পড়ো এবং এই লেখার মধ্যে লেখকের যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে তা খেয়াল করো।
মুহম্মদ আবদুল হাই
প্রায় সাত মাস হলো এখানে এসেছি। সাত মাসে দিন গুনে দিন কুড়ির বেশি সূর্যের আলো দেখেছি বলে মনে হয় না। সকাল বেলায় যদিও সূর্য ওঠে, কিছুক্ষন যেতে না যেতেই বাতাসের বেগ প্রবল হয়, ঠান্ডার প্রকোপ বাড়তে থাকে। আকাশে টুকরো টুকরো মেঘ ভেসে বেড়াতে বেড়াতে জমাট বাঁধে। আকাশ আঁধার হয়ে আসে; ধোঁয়ায়, কুয়াশায় আর মেঘের অন্ধকারে সারা লন্ডন দিনের বেলাটায় ধোঁয়াটে অন্ধকার হয়ে যায়। আমি যে পরিষ্কার সূর্যের দেশের লোক, আমার দেশে সকালে সূর্য ওঠে, সারাদিন প্রখর কিরণ ছড়িয়ে সন্ধ্যাবেলায় পশ্চিম দিগন্তে অস্ত যায়-পরিষ্কার আলোকিত দিনে মন যে সেখানে প্রফুল্ল থাকে, এই সাত মাস ইংল্যান্ডে বাস করে সে কথা ভুলেই যেতে বসেছি।
এই মেঘ, এই ধোঁয়া, এই বৃষ্টি, এই বাতাস, এই কনকনে হাড় ভেদ করা শীত-সবই এ দেশের মানুষের গা- সওয়া হয়ে গেছে। তাই দিনের বেলাকার গোড়ার দিকে হঠাৎ যখন এরা সূর্যের মুখ দেখে, স্নিগ্ধ রোদে চারিদিক যখন ঝলমল করে ওঠে, তখন এদের চোখেমুখে আনন্দের জ্যোতি উপচে পড়ে। পরিচিতে পরিচিতে তো কথাই নেই-অপরিচিতও অপরিচিতকে পথ চলতে গিয়ে মনের আনন্দের ভাগ দেওয়া নেওয়ার জন্য ডেকে বলে- 'কেমন সুন্দর দিনটা, না? হাউ লাভলি'। তার অনুগামী কি সহগামী তার আনন্দ ভাগ করে ভোগ করবার জন্যে ঠিক তেমনি ভাষায় সাড়া দেয়। কিন্তু আলাপ এদেশে বেশি জমে না। ওয়েদার-ই এদের আলাপের পুঁজি। সুতরাং পুঁজি ফুরোলেই চুপ করে যায়।
এরা যেমন চুপ করে থাকতে, আপনার মধ্যে ডুব মেরে থাকতে ভালোবাসে, তেমনি সামান্য কিছু একটা অবলম্বন পেলে প্রাণ খুলে হাসতেও জানে। যে হাসতে জানে, দেখা যায় সে বাঁচতেও জানে। হাসির লহরিতে সব ধুয়ে মুছে যায়। ইংরেজের জাতীয় চরিত্র বড্ড পাক-খাওয়া, কূটবুদ্ধির জন্যে এদের নাম আছে। আর ডিপ্লোমেসির জোরেই এরা এতকাল ধরে দুনিয়াতে প্রভুত্ব করে এলো। কিন্তু এখানে এসে দেখছি ইংরেজ বড়ো কষ্টসহিষ্ণু জাতও। চারিদিকের সাগরের মধ্যে অবস্থিত ইংল্যান্ড একটি দ্বীপবিশেষ। জায়গায় জায়গায় পাহাড়ের মতো উঁচু আর তার পরেই সমতল ভূমির মতো নিচু।
এদের দেশে খাদ্যশস্য বড়ো বেশি ফলে না, যা ফলে তাতে এদের কুলোয় না, তাই বিদেশের দিকে সব কিছুর জন্যেই এদের চেয়ে থাকতে হয়। কিছুদিন থেকে দেখছি গোশত একেবারে উধাও হয়ে গেছে। আর্জেনটিনা, অস্ট্রেলিয়া থেকে এরা মাংস আমদানি করে। আমাদের মতো টাটকা মাংস এরা খেতে পায় না। বিদেশ থেকে তিন চার মাস আগের জবাই করা গোরু, ভেড়া, শুয়োর, খরগোশ জাহাজ বোঝাই করে এদেশে আসে। এরা অতি আদরে সেগুলো দোকানে দোকানে ঝুলিয়ে রাখে। আর মাথাপিছু রেশনে সামান্য একটু যা পায় তাই নিয়ে অতি আনন্দে খায়। দুধ ও দুধজাত জিনিস আসে নিউজিল্যান্ড থেকে। ভিন্ন দেশের জিনিসপত্র না হলে এদের আদৌ চলে না। তাই বলে কি এরা এদের দেশকে কম ভালোবাসে? কত কবি যে এদের আপন দেশের প্রশংসায় মুখর হলেন তা বলে শেষ করা যায় না। এদের দেশ সত্যি ভারি সুন্দর। বৃহত্তম নগরী লন্ডন আর অসংখ্য সাজানো ছোটো গ্রাম আর উঁচুনিচু দিগন্তবিস্তৃত মাঠ নিয়ে সাগরের মাঝখানে গড়ে উঠেছে ইংল্যান্ড দ্বীপ। শেক্সপিয়ার তাঁর দেশকে তাই বলেছেন-রুপালি সমুদ্রের মাঝখানে যেন অমূল্য মণির মতো বসানো রয়েছে এই দেশ ইংল্যান্ড।
এদের প্রকৃতির এই রুদ্র-কঠোরতার কথা যত ভাবি ততই মনে হয় এ জাতটা বড্ড কষ্টসহিষ্ণু আর তেমনি সংগ্রামশীল। রুদ্র প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করে এদেরকে বাঁচতে হয়। তাই মনে হয় কাজের চাপে এরা যেমন অকারণ কথা বলে দুদন্ড সময় নষ্ট করার সুযোগ পায় না, আলাপ জমানোটা এরা যেমন ভুলেই গেছে, তেমনি কাজের বোঝা হালকা করে নেবার জন্যে এরা মুখ খুলে হাসতেও শিখেছে। হাসতে পারা যে কত বড়ো কলা তা বোঝা যায় এদের দৈনন্দিন ব্যাবহারের খুঁটিনাটিতে। এদের আমোদ-প্রমোদ, খেলাধুলায়, সিনেমা- থিয়েটারে, প্যান্টোমাইম কি ব্যালেতে যত না দেখি গম্ভীরভাবে জীবনকে গড়ে তোলার তাগিদ, তার বেশি দেখা যায় হাসির মারপ্যাঁচ। ঘরভরা লোক কথায় কথায় হেসে যাচ্ছে। কোনো গোলমাল নেই-হৈ চৈ নেই। বিরাট জনতার প্রাণখোলা হাসির হররায় সমস্তটা ঘর যেন গমগম করছে। দোকানপাটে যাও-বিশেষ করে ছেলেপুলেদের বিভাগে গেলে দেখা যাবে ছেলেমেয়েদের হাসানোর জন্য কত রকমের খেলনার আয়োজন করে রাখা হয়েছে। এমনভাবে এলিস ইন দি ওয়ান্ডার ল্যান্ড, হামটি ডামটি, পিটার পান্ডা, হিফটি টিফটি প্রভৃতির গল্প বা ছড়াকে আকার দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
দোকানে ঢুকলেই মনে হয় যেন আপনা থেকে কাতুকাতু লাগছে। হাসির আবহাওয়াটাই ছোঁয়াচে।
লন্ডনের বিরাটবই মনকে ঘাবড়ে দেয়। পথে বেরোলে মনে হয় যেন নিজকে হারিয়ে ফেলছি। ফুটপাথে অগণিত জনতার ভিড় আর পথ দিয়ে পিঁপড়ের সারির মতো যানবাহন-সেই কোচ, ট্রাক, টিউব-বাস-ট্যাক্সি। তবু ভাগ্য ভালো-যানবাহনের ধাক্কায় জনস্রোত চাপা পড়ে না। তাদের পথ সুনির্দিষ্ট। শৃঙ্খলা প্রশংসাতীতভাবে সুন্দর। একটা পথের কিছু দূর যেতে না যেতেই জনতা যেন ডান বামের পথে কেটে পড়তে পারে তার সুবন্দোবস্ত আছে। মোড় ঘুরবার সময় তো বটেই, ভার আগেই গাড়িগুলো চলতে চলতে পথের মাঝে প্রয়োজনমতো যেন হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায় আর স্তব্ধগতি গাড়ির সামনে দিয়ে অপেক্ষমাণ জনতা যেন মোড় ঘুরে যায়, সেজন্য রাস্তার মাঝে মাঝে যেমন স্ট্যান্ড থেকে প্রতি দুমিনিট অন্তর লাল হলুদ ও সবুজ বাতি জ্বলে উঠছে, তেমনি পথের বুকে খাঁজ- কাটা জায়গা দিয়েই যেন তারা এক পথ ডিঙিয়ে আর এক পথে যেতে পারে তার সুন্দর নিদর্শনও আছে।
লাল বাতি জ্বলে উঠলে গাড়িগুলোকে সেখানে অবশ্যই দাঁড়াতে হয়। সবুজ বাতি জ্বললে তারা চলার নির্দেশ পায়। লাল ও সবুজের মধ্যে রং বদলানোর জন্য হলুদ বাতি ক্ষণিকের জন্যে জ্বলে। এদের শৃঙ্খলা যেমন পথে পথে, তেমনি বাড়িঘরে আর সবার ওপরে পথচারী মানুষের মধ্যে। ছককাটা স্কোয়ারের মধ্যে বাড়িঘর আর তার চারপাশ দিয়ে রাস্তা। সবই ছবির মতন। এক রকমের পথ। পথের ধারে এক রকমেরই বাড়ি-দালানের পর দালান একইসঙ্গে অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। লন্ডন অতি প্রাচীন শহর। পুরানো ইতিহাসের বয়সের চিহ্ন গায়ে মেখে আর ফ্যাক্টরির ধোঁয়ায় লন্ডনের বাড়িঘরগুলোর রং কালো হয়ে গেছে।
শীতের দেশ। এ কারণে এদের বাড়িঘরগুলোতে বারান্দা নেই, ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে খোলা হাওয়া উপভোগ করে আমাদের দেশের মতো ঘুমে ঢলে পড়বার কোনো অয়োজনও নেই। ঘরের কোনো সৌন্দর্য আছে কি না বাইরে থেকে বুঝবার উপায় নেই। আয়োজন ও সাজসজ্জা সবই ঘরের ভেতরে। এদের রুচি কতো মার্জিত এবং শীত থেকে বাঁচবার জন্যে এদের দরিদ্রতম মানুষও প্রয়োজনের তাড়নায় কীভাবে যে ঘর সাজায় তা এখানে এসে না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না। ঘরের ভেতরের দেয়ালগুলো সুন্দর মসৃণ ওয়ালপেপার দিয়ে মোড়া। মেঝেতে অবস্থা ও বুচিভেদে দামি কার্পেট পাতা।
ঘরের জানালাগুলো কাচের। সে কাচও পুরু এবং খুব বড়ো। শীতের ভয়ে জানলা কালেভদ্রে খোলা হয়। খুললেও মানুষ যখন ঘরে না থাকে তখনই জানালা খোলা হয় অক্সিজেন নেবার জন্যে। কাচের জানালার সঙ্গে রুচিমতো পর্দা দেখা যাবে সব বাড়িতেই ঝুলছে।
লন্ডনের বাড়িঘরের সব চাইতে বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো তার মাটির নিচেকার ঘর। লন্ডনের প্রতি বিন্দু মাটিকে এখানকার লোকেরা কাজে লাগিয়েছে। সব কিছুতেই মাপজোখ করা পরিকল্পনার ছাপ দেখা যায়।
সমস্ত লন্ডন শহরের মাটির নিচে আছে আর একটি জগৎ। সে জগৎ তার টিউবরেলের জগৎ। সেটা যেমন তার মায়াপুরী তেমনি লন্ডনের অধিকাংশ বাড়ির নিচে আছে দু-এক ভলা ঘর। মাটির নিচে ঘর নেই এমন বাড়ি তো আজও চোখে পড়ল না। এ জন্যেই মাটির সঙ্গে লাগানো তলাটিকে এরা ফার্স্ট ফ্লোর বলে না-বলে গ্রাউন্ড ফ্লোর। আমাদের যেটা দোতলা সেটা এদের ভাষায় ফার্স্ট ফ্লোর। মাটির নিচে বেজমেন্টে কমপক্ষে একটা তলা এদের থাকেই। ল্যান্ডলেডিরা সাধারণত বেজমেন্টে বাস করে। বেজমেন্টের ঘর থেকে যেমন সিঁড়ি বেয়ে ওপরের ঘরগুলোয় আসা যায়, তেমনি বাড়ির বাইরেও বের হওয়া যায়। বাইরের জগতের সঙ্গে বাড়িওয়ালাদের দৈনিক জীবনের কারবার হয় এ পথে। আমাদের দেশের লোক হঠাৎ এসে যদি বেজমেন্টের ঘরেরই প্রথম সাক্ষাৎ পায় তাহলে তার মনে প্রশ্ন জাগবে মাটির নিচে মানুষ কী করে জীবন কাটায়। এতদিন পরেও আমি মাঝে মাঝে বিস্মিত হই, মুক্ত বাতাস থেকে এরা নিজেদের কীভাবে আড়াল করে রেখেছে। হলোই না হয় শীতের দেশ।
এদের বাড়িঘর রাস্তাঘাট তৈরির মধ্যে যেমন একটা পরিণত পরিকল্পনার ছাপ আছে, তেমনি সময়মতো মুক্ত হাওয়া খেয়ে আসার জন্য ও শহরের মাঝে মাঝে এরা পার্ক তৈরি করে রেখেছে। পার্কগুলো শহরের প্রাসাদ-সমুদ্রের মধ্যে ছোটো ছোটো সবুজ সুন্দর দ্বীপের মতো। বন্ধ ঘর ও কর্মশালা থেকে বেরিয়ে সারাটা ইংরেজ জাত এই পার্কগুলোতে প্রাণ ভরে মুক্তি ও আনন্দের স্বাদ গ্রহণ করে। এজন্যেই শহরের মহল্লার মাঝে মাঝে এমনিভাবে এত পার্ক লন্ডনের বুকের মাঝে সবুজের মোহ ছড়িয়ে নগরবাসীদের হাতছানি দিচ্ছে।
লন্ডন শহরকে নানা অংশে ভাগ করা হয়েছে। এক একটা অংশকে বোরো বলা হয়। আমাদের যেমন মিউনিসিপ্যালিটি, এখানে তেমনি বোরো। প্রত্যেকটি বোরোতেই অনেক পার্ক আছে। পার্কে দেখা যায় নানা রকমের গাছ, ফুলের বাগান, আর সবুজ ঘাস। এ সবের পেছনে প্রচুর খরচ করতে হয়। পার্কের কোনো অংশ যেন কেউ নষ্ট না করে কিংবা ঘাসের ওপর দিয়ে যেন না হাঁটে সে জন্যে আইনের সাবধানবাণী ছাপানো রয়েছে। লন্ডনের সবচেয়ে বড়ো পার্ক হাইডপার্ক, আর সেন্ট জেমস পার্ক। এগুলো এত বড়ো যে, এদের মাঝখানে এসে পৌঁছলে কর্মমুখর কোলাহলরত লন্ডন শহরের আওয়াজও কানে এসে পৌঁছয় না। পার্কগুলোর বাইরে কাজের চাপে সারা লন্ডন গতিভারে ভেঙে পড়েছে অথচ এদের ভেতরে বিরাজ করছে অনাবিল শান্তি। বাঁধনের মাঝে মুক্তি পাবার অনুরূপ আয়োজন বটে।
শীতে সারা লন্ডনের গাছপালা নেড়া হয়ে গিয়েছিল। পাতা নেই অথচ ডালপালা মাথায় করে গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে, এ যেমন দেখতে ইচ্ছে করে না, তেমনি অদ্ভুত লাগে। বসন্তকালে এসব নেড়া গাছে পাতা বেরিয়ে সবুজে সবুজে নাকি কোলাকুলি করবে। হয়তো বা হতেও পারে। তার প্রস্তুতি চলছে এখন থেকে। সেই প্রতীক্ষায় আমি চেয়ে থাকলাম।
শব্দের অর্থ
বিলেতে সাড়ে সাতশো দিন' রচনার ভিত্তিতে নিচে কয়েকটি প্রশ্ন দেওয়া আছে। তোমার একজন সহপাঠীর সাথে এগুলো নিয়ে আলোচনা করো এবং সংক্ষেপে উত্তর তৈরি করো।
ক. লন্ডন শহরে কী কী বৈশিষ্ট্য লেখকের ভালো লেগেছে এবং কী কী বৈশিষ্ট্য খারাপ লেগেছে?
________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
খ. ইংরেজ জাতিকে লেখক কীভাবে মূল্যায়ন করেছেন?
________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
গ. লন্ডনের আবহাওয়া ও পরিবেশের সঙ্গে তোমার এলাকার আবহাওয়া ও পরিবেশের তুলনা করো
________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
বিলেতে সাড়ে সাতশো দিন' রচনাটির যেসব বক্তব্য নিয়ে তোমার মতামত রয়েছে বা মনে প্রশ্ন জেগেছে, তা নিচের ছকে লেখো। কাজ শেষে কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে উত্তর নিয়ে আলোচনা করো এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো। একটি নমুনা দেওয়া হলো।
বিলেতে সাড়ে সাতশো দিন' রচনায় যা আছে | আমার মতামত ও জিজ্ঞাসা |
---|---|
১. ডিপ্লোমেসির জোরেই এরা এতকাল ধরে দুনিয়াতে প্রভুত্ব করে এলো। | শুধু ডিপ্লোমেসি নয়, দুনিয়ায় প্রভুত্ব বিস্তারের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক শক্তি ও সামরিক শক্তি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। |
২. | |
৩. |
'বিলেতে সাড়ে সাতশো দিন' কোন ধরনের বিবরণমূলক রচনা এবং কেন? উদাহরণ দিয়ে বোঝাও।
_________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
বিবরণমূলক রচনা
স্থান, বস্তু, ব্যক্তি, প্রাণী, অনুভূতি, ঘটনা, ভ্রমণ, অতীতস্মৃতি, ছবি বা কোনো বিষয়ের বিবরণ দেওয়া হয় যে রচনায়, তাকে বিবরণমূলক লেখা বলে। বিবরণমূলক লেখায় লেখকের চিন্তা, অনুভূতি ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়। 'বিলেতে সাড়ে সাতশো দিন' রচনাটি লেখক তাঁর বাস্তব ভ্রমণ-অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে লিখেছেন। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর মূল্যবোধ, অভিজ্ঞতা ও শিক্ষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। কোনো কিছুর বিবরণ দিতে গিয়ে লেখক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটান। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনেক সময়ে পাঠককে প্রভাবিত করতে পারে। নিবিড় পাঠ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পাঠকও লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি উপলব্ধি করতে পারেন। যেমন, 'বিলেতে সাড়ে সাতশো দিন' রচনায় লেখক বলেছেন: 'কাজের চাপে এরা অকারণ কথা বলে দুদন্ড সময় নষ্ট করার সুযোগ পায় না'। এ ধরনের বাক্যের মধ্য দিয়ে লেখক কর্মনিষ্ঠাকে প্রশংসিতভাবে উপস্থাপন করেন এবং পাঠককে কর্মনিষ্ঠ হতে উৎসাহী করতে চান। আবার, আরেক জায়গায় লিখেছেন: 'আমাদের মতো টাটকা মাংস এরা খেতে পায় না।' এর মধ্য দিয়ে পাঠক বুঝতে পারেন, লেখক টাটকা মাংস পছন্দ করেন।
নিচে তথ্যমূলক রচনার তিনটি শ্রেণি দেখানো হলো। কোন শ্রেণির তথ্যমূলক রচনার জন্য কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করা যায়, তা তৃতীয় কলামে লেখো। লেখার পরে সহপাঠীর সঙ্গে আলোচনা করো এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো।
তথ্যমূলক রচনার শ্রেণি | রচনার বৈশিষ্ট্য | কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করা যায় |
---|---|---|
লাইব্রেরি-ভিত্তিক | লাইব্রেরিতে সঞ্চিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে যেসব তথ্যমূলক রচনা লেখা হয় | |
পর্যবেক্ষণ-ভিত্তিক | সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে যেসব তথ্যমূলক রচনা লেখা হয়। | |
অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক | নিজের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে যেসব তথ্যমূলক রচনা লেখা হয়। |
আবু জাফর শামসুদ্দীন (১৯১১-১৯৮৮) একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। তাঁর বিখ্যাত সাহিত্যকর্মের মধ্যে আছে 'ভাওয়াল গড়ের উপাখ্যান', 'পদ্মা মেঘনা যমুনা', 'রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা' ইত্যাদি। নিচে আবু জাফর শামসুদ্দীনের লেখা একটি অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক তথ্যমূলক রচনা দেওয়া হলো। রচনাটি 'আত্মস্মৃতি' বইয়ের অংশবিশেষ।
রচনাটি নীরবে পড়ো এবং এই লেখার মধ্যে লেখকের যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে তা খেয়াল করো।
আবু জাফর শামসুদ্দীন
আমার গ্রাম আমাকে আজীবন আকর্ষণ করেছে। বাংলাদেশ চিরহরিতের দেশ। তবু মনে হয়, আমার গ্রামের গাছপালা লতাপাতার মধ্যে কোথায় যেন আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে।
ভাওয়াল পরগনায় অবস্থিত আমাদের গ্রামটি বর্ষাকালে দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, পশ্চিম ভাগটি হয়ে যায় একটি বিচ্ছিন্ন ছোটো দ্বীপ। পশ্চিম অংশেই আমাদের ভিটেবাড়ি। গ্রামের পশ্চিমে বিশাল মাঠ। বর্ষায় বিরাট বেলাই বিলের সঙ্গে মিশে যায়। বেলাই বিল প্রকৃতপক্ষে একটি মস্ত বড়ো হাওড়-শীতকালে বোরো ধান হয়।
মাঠের সর্বত্র বৈশাখ মাসে কয়েক বছর আগেও কালা আমন, ধলা আমন, খামার বাজাল, কার্তিক শাইল প্রভৃতি ধান ছিটিয়ে বোনা হতো। পানি বৃদ্ধি পায়। ছিটিয়ে বোনা ধানগাছও লম্বা হয়। আষাঢ় মাসে বন্যার জলের সঙ্গে প্রবেশ করে শৈল, গজাল, বোয়াল, রুই, কাতল প্রভৃতি মাছ। কোচ, জুইতা প্রভৃতি অস্ত্র হাতে বেরিয়ে পড়ে গ্রামের মানুষ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। মাঝে মাঝে রোদের ঝিলিক। কোন্দা এবং ডিঙি নৌকায় মাঠ ছেয়ে যায়। কাঁচা ধানের সবুজ শিষ নাড়িয়ে মাছ দৌড়োয়। কোচ, জুইতার ঘাইয়ে বিদ্ধ করে শিকারি।
ভাওয়াল পরগনার বর্ষাকালটা সত্য সত্যই চমৎকার। প্লাবিত মাঠের মধ্যে মধ্যে ছোটো ছোটো দ্বীপসদৃশ পরস্পর বিচ্ছিন্ন গ্রাম। মাইলের পর মাইল সবুজ খানের শিষ। মধ্যে মধ্যে আম, জাম, কাঁঠাল গাছঘেরা চিরহরিৎ পল্লি। পশ্চিমের হরিৎ মাঠ আমাকে মুগ্ধ করত। কেবলই মনে হতো, ঐ সবুজ মাঠটা যদি পাড়ি দিতে পারতাম। না জানি কী রহস্য লুকিয়ে আছে ওপারের ভাসমান গ্রামগুলোতে। বেলাই বিলের ওপর দিয়ে শীতে শীর্ণ বালু নদী প্রবহমান। তার পশ্চিম তীরে প্রতি শনি ও মঙ্গলবারে পুবাইলের হাট বসে। আমাদের গ্রাম হতে ছ-সাত মাইলের পথ। বর্ষায় নদী ও বেলাই একাকার হয়ে যায়। ভাওয়াল পরগনার নানা স্থান হতে তরিতরকারি, কাঁঠাল, আনারস, পেয়ারা, পাট, খান প্রভৃতি বোঝাই ছোটো বড়ো শত শত নৌকো বেলা ওঠার আগেই এসে উপস্থিত হয় পুবাইলের ঘাটে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ হতে যায় বড়ো বড়ো কঞ্জুরার নৌকো। নৌকোয় নৌকোয় কেনাবেচা। সে এক এলাহি কান্ড। আমার গ্রামের ফড়ে বেপারিরা সন্ধ্যারাত্রেই নৌকো বোঝাই করত। কেনাবেচা শেষ করে গ্রামে ফিরে আসত অনেক রাত্রে। আমার মনে হতো সার্থক জীবন ঐ হাটুরেদের।
ছইহীন ডিঙি নৌকোয় চড়ে পুবাইলের হাটে যাওয়ার বায়না ধরেছি। বাবা ঐ হাটে ক্বচিৎ-কদাচিৎ যেতেন। অন্যদের সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি দিতেন না। বেলাইতে নৌকোডুবি হলে রক্ষা নেই। বেলাই সম্বন্ধে নানা উপকথা প্রচলিত ছিল। আমার দাদি বলতেন, এককালে নাকি বেলাই এবং শীতলক্ষ্যা একাকার ছিল। বাইরা গ্রাম হতে পলাশ পর্যন্ত প্রায় ৮/১০ মাইল ছিল খেয়া নৌকোর পাড়ি। রাজা ছিলেন খাটচা ডোশকা নামক জনৈক আদিবাসী। ঝড়ঝঞ্জা বিক্ষুব্ধ বেলাই নাকি রাজপুত্র, পুত্রবধূ এবং নাতি-নাতনি বোঝাই পানসি নৌকো গ্রাস করেছিল। শোকার্ত রাজার মনে প্রতিশোধস্পৃহা জাগে। তিনি শপথ করলেন, ডাইনি বেলাইর বুকে কাগা-বগা (কাক ও বক) চরবে, মাছ খাবে। তিনি বেলাইর পানি নিষ্কাশনের জন্য অসংখ্য খাল কাটান। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে এসব খাল দিয়ে বেলাইর পানি শীতলক্ষ্যায় নেমে যায়। শীতে সত্য সত্যই বেলাইর বুকে কাক-বকেরা হেঁটে হেঁটে মাছ খায়। সারস, সরাইল, পানকৌড়ি, ছেরছেরি পিপি, কোড়া প্রভৃতি নানা পাখি চড়ে বেড়ায়।
আমাদের গ্রামের নিচে একটি বড়ো বিল। আমার বাল্যকালে এই বিলেও একবার বিশাল আকৃতির বড়ো বড়ো পাখির পাঁচ সাতশোর একটি ঝাঁক নেমেছিল। ওরা ঘণ্টা দুঘন্টার মধ্যে বিলের বড়ো বড়ো মাছগুলো নিঃশেষে খেয়ে উড়ে গেল। দাদির মুখে শুত এ লোককাহিনিটি আমার মনে রোমাঞ্চ সৃষ্টি করত। বেলাইর উত্তর প্রান্তে রাজাবাড়ি গ্রাম। ভাবতাম ঐ রাজাবাড়িতেই হয়তো ছিল সুদূর অতীতের সেই মহাপ্রতাপশালী রাজা খাটচা তোশকার রাজধানী।
বেলাই পথে আমার পুবাইলের হাটে যাওয়া হয় আরো অনেক পরে। তখন আমার বয়স দশ-বারো এবং বাবা আমাকে বিলে বন্যার জলে সাঁতার শিখিয়ে ফেলেছেন। ভিটেবাড়ির নিচেই ঢালুতে পাটক্ষেত। আষাঢ়ে পাট কাটা হয়। শ্রাবণে অথৈ পানি। ঐ পানিতেই আমি আর আমার ছোটো দুভাই সাঁতার শিখেছিলাম। গোসলের আগে বাবা ঘণ্টা দুঘন্টা মসজিদের ঠান্ডা মেঝেয় অথবা বাংলা ঘরের তক্তপোশে ঘুমোতেন। ঐ সময়টায় আমি ছিলাম ফ্রি। পাড়ার ডানপিটে ছেলেদের সঙ্গে সাঁতার কাটতে বিলে নামতাম। ঘণ্টা দুঘন্টা ঝাঁপুড়ি খেলা চলত। মনে পড়ে একদিন ধরা পড়েছিলাম। সময় ব্যাপারে হুঁশ ছিল না। তখন প্রায় একটা বাজে। ঘুম হতে জেগে আমাকে না পেয়ে বাবা কফির লাঠি হাতে খুঁজতে বের হন। বাড়ির দক্ষিণ-পুবের এক বিলে আমাকে পাওয়া গেল। তাকে বিলের যে পাড়ে দেখা গেল আমি সে পাড়ে উঠলাম না। অন্য পাড় দিয়ে উঠে এক দৌড়ে বাড়ি পৌঁছে দাদির আশ্রয় নিলাম।
দাদির বয়স তখন একশো কিন্তু তখনও তিনি বেশ শক্ত-সমর্থ। মেরুদন্ড ঠিক। বাবা তাঁকে আম্মা সাব ডাকতেন। মায়ের কথার পৃষ্ঠে কথা তিনি কখনো বলতেন না। বাবা ছিলেন দাদির একমাত্র পুত্রসন্তান। তাঁর নয় বছরের ছোটো ছিলেন আমার ফুপু-ব্যাস এই দুজন। হাটবাজারে এবং ঢাকা যাওয়ার সময়, বাবা দাদিকে জিজ্ঞাসা করতেন, আম্মা সাব আপনার জন্য কী আনব? দাদির ফরমাশ ছিল এগুলো: পান, মজালো সুপারি, এলাচি, দারুচিনি, গুয়ামৌরি, যষ্টিমধু, মগাই খয়ের, মতিহারি সাদাপাতা, গুড়, কলা, খিরসা প্রভৃতি। দাদি দুধ-দই ভালোবাসতেন। শিং, মাগুর, শৈল, গজাল, টাকি, বোয়াল, ইত্যাদি মাছ খেতেন না। কবুতর এবং মোরগ ব্যতীত অন্য কোনো প্রাণীর গোশতও খেতেন না তিনি।
পিতামহ ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত ছিলেন। ১৮৫৭ সালের ফৌজি বিদ্রোহে ঢাকার দেশি সিপাইরাও যোগ দিয়েছিল। বিদ্রোহ দমনকে উপলক্ষ করে ঢাকা শহরে ব্যাপক গণহত্যা শুরু হয়। শুনেছি লালবাগ কেল্লা এবং তৎসন্নিহিত এলাকা ঘেরাও করে তোপ দাগা হয়। এর ফলে নাকি প্রায় পাঁচ হাজার লোক মারা যায়। মৌলবি মুনশিরা ছিলেন ইংরেজের বিশেষ লক্ষ্য। ওদের পেলেই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হতো। আন্ডাঘরের ময়দানে (বাহাদুর শাহ পার্ক) গাছগুলোতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল অসংখ্য মানুষ। দাদা ঐ সময়ে প্রাণভয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন। ঢাকা ছাড়ার পর তিনি মসজিদকে কেন্দ্র করে সংগ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহের বালক-বালিকাদের দিনি এলেম শিক্ষাদানে নিযুক্ত হন।
১৮৫৯-৬০ সালের দিকে মওলানা কেরামত আলী জৌনপুরী বেশ কিছুকাল আমাদের বাড়িটিকে তাঁর আস্তানা করেন। দাদা তাঁর শিষ্য হন। দুজনে মিলে আমাদের অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন। বিদ্যাশিক্ষা দানের বিনিময়ে দাদা কোনো পারিশ্রমিক গ্রহণ করতেন না। বাবাও ঐ ঐতিহ্য রক্ষা করেছিলেন। আমার বাল্যকালে বহু ছাত্রছাত্রী তাঁর কাছে পড়তে আসত। বাবার কাছে শুনেছি, দাদার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে নাকি তিনশো কেতাব ছিল। তাঁর মধ্যে বেশ কিছুসংখ্যক হস্তাক্ষরে লিখিত গ্রন্থও ছিল। দু-চারটি আমি নিজেও দেখেছি। বাবার ১৭ বছর বয়সে দাদার মৃত্যু হয়। আত্মীয়স্বজনরা বহু কেতাব নিয়ে যায়। আমার বাল্যকালেও ৭০টি কেতাব ছিল। তার মধ্যে একটি ছিল আরবি অক্ষরে লিখিত বাংলা কেতাব। ১৯১৯ সালে ১২ ঘণ্টাব্যাপী ভয়াবহ ঝড়ে টিনের চাল উড়িয়ে নিয়ে যায়। আমরা মসজিদে আশ্রয় গ্রহণ করি। সারারাত ব্যাপী ঝড়বৃষ্টিতে পিতামহের স্মৃতিবিজড়িত কেতাবগুলো প্রায় সবই নষ্ট হয়ে যায়। উর্দু 'কাসাসুল আম্বিয়া' গ্রন্থটি পিতামহের লাইব্রেরির একমাত্র নিদর্শনরূপে এখন আমার কাছে আছে।
১৯১৯-২১ সালের কংগ্রেস খেলাফত আন্দোলনের সময়ে আমাদের গ্রামের উত্তর দিকের এক বড়ো চত্বরে এক বিশাল জনসভা হয়। বাবা সেই স্বদেশি জনসভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন। সভায় জনৈক পাগড়িধারী মুসলিম বক্তার মুখে আমি সর্বপ্রথম জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের বিষয় এবং ব্রিটিশ ব্যুরোক্রেসি শব্দ দুটি শুনি। মনে হয়, উক্ত বক্তণ দেওবন্দি আলেম ছিলেন। সেকালে আমাদের অঞ্চলে বহু যুবক পড়াশোনা করতে দেওবন্দ যেত। মহাত্মা গান্ধী এবং আলী ভাইদের নামে জয়ধধ্বনি শুনেছিলাম সেদিনই প্রথম। বন্দে মাতরম এবং আল্লাহ আকবর দুই-ই ছিল সভার স্লোগান। সভাশেষে স্থানীয় কংগ্রেস-কাম-খেলাফত কমিটি গঠিত হয়। বাবা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। মনে পড়ে, তিনি বাড়িতে চরকা নিয়ে আসেন। দাদি কোম্পানির আমলের মানুষ- সুতো কাটতে জানতেন। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে গ্রামের প্রায় সকলের বাড়িতে চরকা বসল। দাদি অনেককে সুতো কাটতে শিখিয়েছিলেন। ঘরে ঘরে মুষ্টির ঘাট। প্রতি শুক্রবারে মসজিদে মুষ্টির চাল জমা হতো। সে চাল পৌঁছে দেয়া হতো কেন্দ্রীয় কংগ্রেস খেলাফত অফিসে।
বাবার নিত্যকার পোশাক ছিল সাদা পাঞ্জাবি, সাদা তহবন, সাদা টুপি, চটি জুতো এবং ছাতা। তৎকালে হিন্দু- মুসলিম নির্বিশেষে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকদের অধিকাংশ চটি জুতো ব্যবহার করত। হিন্দু মহিলারা জুতো পরত না। মুসলিম মহিলারাও সাধারণত চটি জুতা পরত না-কারও কারও প্যাটেন্ট লেদারের ফুলতোলা রঙিন পাম্পশুও ছিল। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সাধারণ চাবি পরিবারের মহিলাদের একমাত্র পরিচ্ছদ ছিল পেঁচিয়ে পরা একটি শাড়ি। সারাদিন নগ্নপদে কাজ করার পর রাত্রে পা ধুয়ে কেউ কেউ খড়ম পরত। অনেকের তাও ছিল না। প্রচন্ড শীত পড়লে চাষি পুরুষেরা তাল গাছের ডালার গোড়ার ঘোল মাপ অনুযায়ী কেটে তার মধ্যে দড়ির বেড় দিয়ে এক ধরনের স্যান্ডেল তৈরি করে নিত। এগুলোকে বলা হতো 'পাওটি'। অধিকাংশ চাষি পরিবারে শৌচকার্য ও হাত ধোয়ার জন্য মাটির লোটা এবং ভাত খাওয়ার জন্য মাটির সানকি ব্যবহৃত হতো। কলসিও ছিল মাটির। শয্যা ছিল বাঁশ-বেতির দরমা। শীতকালে দরমার নিচে খড়কুটো এবং দরমার ওপরে কাঁথা বিছানো হতো। আমাদের বাড়িতে কেরোসিনের কুপি জ্বলত। ঝড়-বাদলের রাত্রির জন্য একটি ল্যান্টার্নও ছিল। অধিকাংশ লোকের বাড়িতে বুহুইনা গাছের বিচি হতে সংগৃহীত তেলের প্রদীপ জ্বলত। এই প্রদীপের নাম ছিল 'মুছি'।
আমাদের গ্রামে আট দশটি পরিবারের একটি ব্রাহ্মণপাড়া ছিল। একটি পরিবারের উপাধি ছিল চক্রবর্তী। বাকি সবাই ছিল ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ এবং একই গোত্রভুক্ত। অবশিষ্ট হিন্দুদের মধ্যে কয়েক ঘর গোয়ালা ব্যতীত বাকি সবাই ছিল নমঃশূদ্র। নমঃশূদ্রদের তিন চারটি পরিবার কামার, ছুতোর ও করাতির কাজ করত। অন্যেরা ছিল কৃষিজীবী। গোয়ালাদের মধ্যে একটি পরিবারের এবং একটি নমঃশূদ্র পরিবারের বহু জমিজমা ছিল। তালুক স্বত্বেও ছিল ওদের অংশ। সুতরাং রাইয়ত প্রজাও ছিল। ব্রাহ্মণরাও তালুকদার ছিল। খাসখামার জমিও ছিল ওদের। ওরা নিজে চাষবাস করত না, খাসখামার জমি নমঃশূদ্র ও মুসলমান চাষি বর্গা করত। অধিকাংশ ব্রাহ্মণ পরিবারের সুদি কারবার ছিল। অনাদায়ি রেহানি ঋণের দায়ে মুসলমান ও নমঃশূদ্র চাষিদের জোতজনি সুদখোর ব্রাহ্মণ পরিবারগুলোর অধিকারে চলে যাচ্ছিল। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ দেওয়া হতো। তিরিশের দশকে ঋণ সালিশি বোর্ড হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত উক্ত অর্থনীতির বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকার ছিল না। মুসলমানদের মধ্যে প্রায় সকলের পেশা ছিল স্বহস্তে জমি চাষ অথবা জনমজুরি। বর্ষার অবসরকালটায় কেউ কেউ পাট ও তরিতরকারির কারবার করত। পাটের মৌসুমে একটি পরিবার বাকরখানি রুটি তৈরি করে ফেরি করত। গৃহস্থ গৃহিণীর পাটের বিনিময়ে বাকরখানি রুটি এবং বেদেনিদের কাছ থেকে রেশমি চুড়ি রাখত।
গ্রামে লেখাপড়ার চর্চা বিশেষ একটা ছিল না। মুসলমানদের মধ্যে একমাত্র আমার পিতাই মোটামুটি শিক্ষিত লোক। তিনি বাংলা ছাড়াও উর্দু ও ফারসি বলতে পারতেন। আমার মা বাংলা বইপত্র পড়তে পারতেন, কিন্তু লিখতে পারতেন না। আমার ফুপুও বাংলা, উর্দু, ফারসি বলতে ও লিখতে পারতেন। মুসলমান সম্প্রদায়ের ব্যকি অধিকাংশই ছিল নিরক্ষর। কেউ কেউ কায়ক্লেশে নাম স্বাক্ষর করতে এবং পুথি পড়তে পারত। সমাজে পুথি পড়ুয়াদের বিশেষ সম্মান ছিল। আমির হামজা, সায়ফুল মূলক ও বদিউজ্জামাল, সোনাভান প্রভৃতি পুথি বিশেষ জনপ্রিয় ছিল। জ্যোৎস্নালোকিত উঠানে বগুনার ওপর কুপি জ্বালিয়ে পুথির মজলিস বসত। বাবা এসব পছন্দ করতেন না। আমাদের বাড়িতে পুথির মজলিস বসতে কখনো দেখিনি। খান, পাট, আখের চাষ হতো গ্রামে। শীতকালে আখ ভাঙাবার গাছ আসত। গ্রামের ছেলেরা আখের গাছের জোয়াল ঠেলত। আমিও ঠেলেছি। এই পরিবেশে কেটেছে আমার বাল্যকাল।
শব্দের অর্থ
'আত্মস্মৃতি' রচনার ভিত্তিতে নিচে কয়েকটি প্রশ্ন দেওয়া আছে। তোমার একজন সহপাঠীর সাথে এগুলো নিয়ে আলোচনা করো এবং সংক্ষেপে উত্তর তৈরি করো।
ক. এই রচনায় কোন সময়ের তথ্য পাওয়া যায়?
_________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
খ. গ্রামের প্রকৃতির বর্ণনার মধ্য দিয়ে লেখকের কোন মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে?
_________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
গ. এই রচনায় সামাজিক-রাজনৈতিক যেসব তথ্য পাওয়া যায়, সেগুলো উপস্থাপনের সময়ে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি কতটুকু নিরপেক্ষ বা পক্ষপাতমূলক, তা আলোচনা করো।
_________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
'আত্মস্মৃতি' রচনাটির যেসব বক্তব্য নিয়ে তোমার মতামত রয়েছে বা মনে প্রশ্ন জেগেছে, তা নিচের ছকে লেখো। কাজ শেষে কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে আলোচনা করো এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো। একটি নমুনা দেওয়া হলো।
আত্মস্মৃতি' রচনায় যা আছে | আমার মতামত ও জিজ্ঞাসা |
---|---|
১. ১৯১৯ সালে ১২ ঘন্টাব্যাপী ভয়াবহ ঝড়ে টিনের চাল উড়িয়ে নিয়ে যায়। | অনলাইনে খোঁজ করে দেখেছি, এই তথ্যটি ঠিক আছে |
২. | |
৩. |
'আত্মস্মৃতি' শিরোনামের লেখাটিকে কেন অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক তথ্যমূলক রচনা বলা যায়? তোমার উত্তরের পক্ষে যুক্তি দাও।
__________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
তথ্যমূলক রচনা
তথ্য পরিবেশন করাই যে রচনার মূল লক্ষ্য তাকে তথ্যমূলক রচনা বলে। তথ্যমূলক রচনা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে; যেমন:
১. লাইব্রেরি-ভিত্তিক: লাইব্রেরিতে সঞ্চিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে লাইব্রেরি-ভিত্তিক তথ্যমূলক রচনা লেখা হয়। এ ধরনের তথ্যমূলক রচনা লেখার জন্য লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত পত্রপত্রিকা, বই, দলিলপত্র, নথিপত্র, বিভিন্ন ধরনের প্রত্নবস্তু, পুথি, অডিও-ভিডিও ইত্যাদি থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
২. পর্যবেক্ষণ-ভিত্তিক: সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পর্যবেক্ষণ-ভিত্তিক তথ্যমূলক রচনা লেখা হয়। এ ধরনের তথ্যমূলক রচনা লেখার জন্য সরেজমিনে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের জরিপ, সাক্ষাৎকার, দলীয় আলোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
৩. অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক: নিজের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক তথ্যমূলক রচনা লেখা হয়। এ ধরনের তথ্যমূলক রচনা লেখার জন্য নিজের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের অভিজ্ঞতার স্মৃতি, ডায়েরি, পারিবারিক সংগ্রহ ইত্যাদি থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
বিশ্লেষণমূলক রচনায় কখনো উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়, কখনো তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। কোনো কোনো বিশ্লেষণমূলক রচনায় একইসঙ্গে উপাত্ত ও তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। নিচে কিছু নমুনা দেওয়া হলো। এর মধ্যে কোনটি উপাত্ত এবং কোনটি তথ্য তা ভান কলামে লেখো। প্রথম দুটি করে দেখানো হলো। লেখার পরে সহপাঠীর সঙ্গে আলোচনা করো এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো।
আবদুল হক (১৯১৮-১৯৯৭) বাংলাদেশের একজন সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। তাঁর লেখা গ্রন্থের মধ্যে আছে 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ', 'ভাষা আন্দালন: আদি পর্ব' ইত্যাদি। নিচে ১৯৭৩ সালে রচিত আবদুল হকের একটি প্রবন্ধ দেওয়া হলো। এটি লেখকের 'সাহিত্য ও স্বাধীনতা' বই থেকে নেওয়া হয়েছে।
রচনাটি নীরবে পড়ো এবং এই লেখার মধ্যে লেখকের যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে তা খেয়াল করো।
আবদুল হক
বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হলো যোলোই ডিসেম্বর, বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচাইতে বিখ্যাত এবং উজ্জ্বল দিবসে। কোনো নবজাত রাষ্ট্রের সংবিধান রচনাই বড়ো ঘটনা, কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান রচনার একটা পুরুত্ব এই যে, ইতিহাসে এই প্রথম বাংলা ভাষায় একটি রাষ্ট্রের সংবিধান রচিত হলো। রাজনৈতিক সংগ্রাম ছাড়াও এ সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে। আর এই কারণে শুধু রাজনৈতিক সংগ্রামের নয়, ভাষা আন্দোলনেরও শ্রেষ্ঠতম বিজয়স্তম্ভ বাংলাদেশের সংবিধান। বিজয় দিবস, সংবিধান দিবস এবং ভাষা আন্দোলনের একটি বিশেষ পরিণতি লাভ একসঙ্গে মিশে গেল।
বাংলা ভাষার এবং ব্যাপকতন অর্থে বাংলা সাহিত্যের অগ্রগতির দিক দিয়ে দেখতে গেলে এই সংবিধান রচনার একটা তাৎপর্য হচ্ছে এই, এটি ভাষার বিশেষ এক গুণগত পরিণতি লাভের উদাহরণ। সংবিধানের কাজ রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও কাঠামোকে ধরে রাখা, এমন ভাষায় যার মধ্যে ভাবাবেগ, অস্পষ্টতা, স্বার্থতা, বাহুল্য অথবা অন্য কোনো প্রকার ত্রুটি এবং শৈথিল্যের অবকাশ নেই। গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান যৌথ রাষ্ট্রচিন্তাকে রূপদান করে, যাঁরা সংবিধান রচনায় ব্যাপৃত থাকেন শুধু তাঁদের চিন্তা নয়, সমগ্র জাতির চিন্তাও। সেই সঙ্গে কয়েক শতাব্দীর আন্তর্জাতিক চিন্তা ও অভিজ্ঞতাও এর উপর ছায়াপাত করে। যাঁরা সংবিধানের প্রকৃত রচয়িতা এবং জনসমাজের রাজনৈতিক প্রতিনিধি তাঁরা বাংলা ভাষাবিদগণেরও সহায়তা নিয়েছেন। সম্মিলিতভাবে তাঁদের মনে রাখতে হয়েছে আদালতে এবং ময়দানের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জের কথা। প্রতিটি বাক্য এবং শব্দকে সোনার মতো সুক্ষ্মভাবে ওজন ও যাচাই করে দেখতে হয়েছে, সেই সঙ্গে দেখতে হয়েছে যেন সংবিধানের ভাষা বাংলা হয়, শুভ বাংলা হয় এবং পাঠযোগ্য বাংলা হয়।
জাতীয় সংসদে, নিশ্চিতভাবে ধরা যায়, এখন থেকে বাংলা ভাষাতেই আইন প্রণীত হবে। প্রধানমন্ত্রী বিচারপতিদের অনুরোধ করেছেন বাংলায় মামলার রায় লিখতে। দু-একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে বাংলা ভাষায়। এসবই বাংলার জন্য নতুন কাজ। একেবারে আনকোরা কাজ বোধ হয় বলা চলে না, তবে এসব ক্ষেত্রে এমন সর্বাত্মক আত্মনিয়োগের দায়িত্ব আর কখনো ভাষার উপর এসে পড়েনি। এসব কাজে আবেগে, বাহুল্যে, শৈথিল্যে, অস্পষ্টতার ভারে তার নুয়ে পড়ার অবকাশ নেই, নিটোলদেহ কর্মীর মতো তাকে ফিটফাট হয়ে উঠতে হবে। কোনো রকম সাহিত্য সৃষ্টি নয়, বাস্তব কর্মনিপুণতাই হবে তার যোগ্যতার মাপকাঠি।
আরো দুটি ক্ষেত্রে বাক্য ও শব্দকে সবসময়ে ঠিক ঐ রকম সোনার মতো ওজন করার দরকার না হলেও যথেষ্ট কর্মনিপুণ হতে হবে। সেই দুটি ক্ষেত্র হচ্ছে প্রশাসন ও উচ্চশিক্ষা। প্রশাসনের ভাষা এবং উচ্চশিক্ষার মাধ্যম, সঠিকভাবে বলতে গেলে প্রধান মাধ্যম হবে বাংলা। সব রকমের জ্ঞান ধরে রাখতে হবে এবং ছাত্রদের কাছে পরিবেশন করতে হবে বাংলা ভাষায়, যে সব দুরূহ বিষয়ে বাংলা ভাষায় কখনো কিছু লেখা হয়নি সেসব বিষয়েও। শিক্ষণীয় সব বিষয়ের মাধ্যম হবে বাংলা, যদিও বিশেষজ্ঞ খ্যাতনামা বিদেশি পণ্ডিতদের লেখা বই চিরদিন ইংরেজি ভাষায় পড়তে হবে শিক্ষার এবং জ্ঞানের পূর্ণতার জন্য। শুধু ইংরেজি ভাষায় কেন, সকল উন্নত ভাষায়। দুরূহ বিষয়কে প্রকাশ করার ক্ষমতা বাংলা ভাষার আছে, এ পরিচয় উনিশ শতক থেকেই কমবেশি পাওয়া যাচ্ছে।
সংবিধান, আইন এবং মামলার রায়, প্রশাসনিক চিঠিপত্র এবং সরকারি আধা-সরকারি সংস্থাসমূহের ব্যবস্থাপনা ও প্রতিবেদন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষণীয় বিচিত্র প্রকার বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয় সংক্রান্ত গ্রন্থ, যন্ত্রবিদ্যা এবং অন্যান্য বাস্তব কাজের বিষয় সংক্রান্ত প্রকাশনা সাহিতা নয়, কিন্তু এরা সকলে মিলে ভাষার প্রকাশ ক্ষমতাকে সম্প্রসারিত করে এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতির পটভূমি রচনা করে। পশ্চিমবঙ্গ অপেক্ষা বাংলাদেশেই এর সম্ভাবনা অধিক প্রশস্ত; কেননা এদেশে সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। জ্ঞান ও সংস্কৃতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য যতখানি ইংরেজির প্রয়োজন তার অতিরিক্ত সবকিছু ধারণ ও প্রকাশের দায়িত্ব নিতে হবে বাংলা ভাষাকে। পক্ষান্তরে পশ্চিমবঙ্গে অনেকগুলি ক্ষেত্র থেকে শুধু সর্বভারতীয় প্রয়োজনে ইংরেজিকে সরানো ঘাবে না। এবং অনেক ক্ষেত্রে একই প্রয়োজনে হিন্দিকে জায়গা দিতে হবে, জ্ঞান ও সংস্কৃতির নিজস্ব প্রয়োজনে নয়। এই কারণে পশ্চিমবঙ্গ অপেক্ষা বাংলাদেশেই বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ অধিকতর উজ্জ্বল। অধিকন্তু ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম এবং বিশেষ করে সশস্ত্র সংগ্রামের যে বিপুল অভিজ্ঞতা বাঙালির হয়েছে তাও একটা মহৎ সাহিত্যের রূপ পাওয়ার জন্য প্রতীক্ষা করছে। অপ্রতিরোধ্য প্রয়োজনের চাপেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বাংলাদেশে সমৃদ্ধ হতে হবে, হওয়ার সম্ভাবনা অপরিসীম।
(সংক্ষেপিত)
শব্দের অর্থ
বাংলা ভাষা: সংকট ও সম্ভাবনা' রচনার ভিত্তিতে নিচে কয়েকটি প্রশ্ন দেওয়া আছে। তোমার একজন সহপাঠীর সাথে এগুলো নিয়ে আলোচনা করো এবং সংক্ষেপে উত্তর তৈরি করো।
ক. ১৬ই ডিসেম্বর তারিখটি কোন দুটি কারণে লেখকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ?
________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
খ. বাংলা ভাষায় সংবিধান রচনার ব্যাপারটি লেখকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কেনা
________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
গ. বাংলাদেশে বাংলা ভাষার প্রসার ও সমৃদ্ধির সম্ভাবনা বেশি কেন? তোমার মতামত দাও
________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
বাংলা ভাষা: সংকট ও সম্ভাবনা' রচনাটির যেসব বক্তব্য নিয়ে তোমার মতামত রয়েছে বা মনে প্রশ্ন জেগেছে, তা নিচের ছকে লেখো। কাজ শেষে কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে উত্তর মেলাও এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো। একটি নমুনা দেওয়া হলো।
বাংলা ভাষা: সংকট ও সম্ভাবনা' শিরোনামের রচনাটিকে কেন বিশ্লেষণমূলক লেখা বলা যায়? উদাহরণ দিয়ে বোঝাও।
________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
বিশ্লেষণমূলক রচনা
বিশ্লেষণমূলক রচনার উপকরণ দুই ধরনের: উপাত্ত এবং তথ্য।
উপাত্ত বলতে বোঝানো হয় একই ধরনের কিছু পরিমাণগত বা গুণগত বৈশিষ্ট্য, যেগুলো এলোমেলোভাবে সাজানো থাকতে পারে। যেমন: প্রতিদিন ভোরে হাবিব সাহেব ২ মাইল দৌড়ান, রহমান সাহেব ১ মাইল দৌড়ান এবং জামিল সাহেব ১.৫ মাইল দৌড়ান। এটি পরিমাণগত উপাত্তের উদাহরণ। আবার সেলিম ফুটবল খেলে, আবেদ ক্রিকেট খেলে, সুমন দাবা খেলে, জিসান হাডুডু খেলে। এটি গুণগত উপাত্তের উদাহরণ।
উপাত্ত ও তথ্য বিশ্লেষণ করে নতুন নতুন তথ্য তৈরি হয়। এভাবে বিশ্লেষিত তথ্য দিয়ে যে রচনা লেখা হয়, তাকে বিশ্লেষণমূলক রচনা বলে। 'বাংলা ভাষা: সংকট ও সম্ভাবনা' রচনায় লেখক কিছু তথ্য বিশ্লেষণ করে নতুন তথ্য তৈরি করেছেন। যেমন, পাকিস্তান-পর্বে ভাষা আন্দোলন হয়েছে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে এবং ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদে গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়েছে বাংলা ভাষায়। এই তিনটি তথ্যের মধ্যে প্রাবন্ধিক যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন, 'বিজয় দিবস, সংবিধান দিবস এবং ভাষা আন্দোলনের একটি বিশেষ পরিণতি লাভ এক সঙ্গে মিশে গেল।' তাঁর মতে, ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করেছে বাংলা ভাষায় সংবিধান রচনার মধ্য দিয়ে। প্রাবন্ধিকের এই মন্তব্যটি বিশ্লেষণমূলক।
নিচে কয়েক ধরনের কল্পনানির্ভর রচনার তালিকা দেওয়া হলো। এসব কল্পনানির্ভর রচনার বৈশিষ্ট্য কী, ডানের কলামে লেখো। লেখার পরে সহপাঠীর সঙ্গে আলোচনা করো এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো।
কল্পনানির্ভর রচনায় শ্রেণি | রচনার বৈশিষ্ট্য |
---|---|
রূপকথা | |
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি | |
রম্যরচনা |
নিচে গোলা গোলাম মুরশিদের লেখা একটি কল্পনানির্ভর রচনা দেওয়া হলো। রচনাটি আমেরিকান লেখক লিও বুসকাগলিয়ার যার (১৯২৪-১৯৯৮) কাহিনির ছায়া অবলম্বনে রচিত।
গোলাম মুরশিদ (জন্ম ১৯৪০) বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত প্রাবন্ধিক ও গবেষক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ 'আশার ছলনে ভুলি', 'হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি', 'বিদ্রোহী রণক্লান্ত' ইত্যাদি।
গোলাম মুরশিদ
কখন যে বসন্ত চলে গেছে টেরই পাইনি। গরমের সুন্দর হাওয়া গা জুড়িয়ে দিচ্ছে। আমার জন্ম মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে, পাহাড়ের গায়ে। তাই ভারি ভালো লাগছে এই উষ্ণ হাওয়া। আমার নাম কিশলয়। এখনো কিশোর আমি। প্রথম আমি চোখ মেলে তাকিয়েছিলাম বসন্তের এক ভোরবেলায়। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখছিলাম চারদিকটা। আমার বাসা একটা বড়ো গাছের মগডালে। আমার চারদিকে আমারই মতো শত শত পাতা। তোমরা বোধহয় পাতাগুলোকে ভাবো একই চেহারার। কিন্তু একটু খেয়াল করে দেখো, হুবহু একই চেহারার দুটি পাতা পাবে না তুমি। আমার ধারেই থাকে 'আলো'। আলোর মতোই তার স্বভাবটা হালকা-
খিলখিল করে হাসে। আর ডান পাশে বেণু। পর্ণা থাকে একটু সামনে, ওপরের দিকে।
ছেলেবেলা থেকে আমরা সবাই বাতাসের সঙ্গে গাইতে শিখেছি, নাচতে শিখেছি। রোজ রোদে স্নান করি। কী যে ভালো লাগে। তারপর বিকেল বেলা যখন আলো কমে আসে; আমার মন খারাপ করে তখন। আলো, বেলু, পর্ণী-ওদেরও করে বোধহয়।
মাঝেমধ্যে বৃষ্টি নামে। তার ধারায় স্নান করতে আমার খুব ভালো লাগে। সমস্ত শরীরটা ধুয়ে যায়। সে বৃষ্টিও কি এক রকম! কখনো ঝিরঝির করে ঝরতে থাকে। কখনো অঝোর ধারায় যেন রাগ করে ঝরতে থাকে। সমস্ত আকাশ কাঁপিয়ে সে গর্জন করতে থাকে। তার রাগী চোখের দৃষ্টি দিয়ে সমস্ত আকাশটাকে আলোতে ঝলসে দেয়। কিন্তু একটু পরই যখন তার মেজাজ ভালো হয়, তখন রোদ হেসে ওঠে।
আলোর কথা বলেছি, বেণুর কথা বলেছি, পর্ণার কথাও। কিন্তু এখনো শোনোনি আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধুর কথা। তার নাম ঋষি। সে অনেক কিছু জানে।
ঋষিই একদিন বলেছিল আমাকে, আমরা নাকি সবাই একটা গাছের অংশ। গাছটা আছে একটা ছোটো গাঁয়ের এক পাশে-একটা বাগানে। গায়ের লোকেরা একে বলে পার্ক। সবুজ ঘাস বিছানো একটা মাঠ আছে সেই বাগানে। চারদিকে অনেক গাছ। নানা ধরনের গাছ। কোনোটার পাতা বড়ো, কোনোটার ছোটো। কারও পাতা বেশ গোল, কারও লম্বাটে। যে গাছে আমার জন্ম তার পাশেই আছে একটা দেবদারু গাছ। লম্বা লম্বা কোঁকড়ানো পাতা। কিন্তু দূরে আছে একটা মজার গাছ। তার পাতাগুলো খুব সরু আঁশের মতো। যখন তার গায়ে হাওয়া লাগে, তখন শোঁ শোঁ করে সে গান করে। অন্য গাছের পাতারা চুপ করে শোনে। মাঝেমধ্যে তারা ঝরঝর মড়মড় করে তালি দেয়। পাতার মতোই-অনেক গাছে ফল ধরে, আবার অনেক গাছে ফল ধরে না। যে গাছে আমার জন্ম, সে গাছে কোনো ফল ধরে না।
একদিন ঋষি বলেছিল, গাছগুলো মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু মাটির তলায় আছে তাদের শেকড়। লম্বা, মোটা, খুব শক্ত শেকড়। মাট আঁকড়ে ধরেই গাছগুলো দাঁড়িয়ে থাকে। রোজ গাছের ডালে এসে বাসে নানা রকমের পাখি। গাছের ডালেই তারা বাসা বাঁধে। রাতের বেলা ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু রাত পোয়ানোর আগেই তাদের ঘুম ভেঙে যায়।
আমি যে একটা পাতা-এটা ভাবতে খুব ভালো লাগে আমার। ভালো লাগে আশপাশের বন্ধুদের। আর আমি সত্যি ভালোবাসি যে গাছে আমার জন্ম, তাকে। সেই তো আমার মা। তার রস খেয়েই নাকি আমরা বেঁচে আছি-মায়ের দুধের মতো। আমি যে ঘুড়ির মতো আকাশে ভেসে থাকি, হাওয়ার সঙ্গে তালে তালে নাচি- সে কথা ভাবতেই আমার শরীরটা কেমন শিউরে ওঠে।
এবার গরমের সময়ে অনেকেই বেড়াতে এসেছে এই বাগানে। ছেলেমেয়েরা। বুড়োবুড়িরা। নানা বয়সের অনেক লোক। অনেকে এসে বসেছে আমাদেরই ছায়ায়। ছায়া দিতে আমার ভারি ভালো লাগে। একদিন পর্ণীকে জিগগেস করেছিলাম, সে বলেছিল ছায়া দিতে তারও নাকি খুব ভালো লাগে। ঋষি তো সবই জানো একদিন সে আমাকে বলেছিল, ছায়া দেওয়া নাকি আমাদের জীবনের একটা লক্ষ্য।
লক্ষ্য? আমি অবাক হয়ে শুনেছিলাম। তারপর ঋষিকে জিগগেস করলাম, 'লক্ষ্য কী?'
ঋষি বলল, 'লক্ষ্য হলো বেঁচে থাকার একটা উদ্দেশ্য।' তারপর বুঝিয়ে বলল, 'আমরা যে জন্মেছি, আমরা যে বেঁচে আছি, এর কারণ কী? বেঁচে থেকে যদি অন্যদের জীবনটাকে একটু সুখ দিতে পারি, অন্যের মুখে হাসি ফোটাতে পারি, তাহলে বাঁচার একটা মানে হয়। তাই না? যেমন ধরো, গরমে বেশ কাতর হয়ে বুড়োবুড়িরা বাড়ি থেকে বাগানে আসে হাওয়া খেতে, শরীরটা জুড়াতে, একটু বিশ্রাম করতে, তখন আমরা ছায়া দিলে তাদের ভালো লাগে। নয়তো তারা কোথায় বসবে, বলো? বাচ্চারা খেলতে আসে এই পার্কে। তারা কি গরম রোদের মধ্যে খেলবে? আমাদের ছায়ায় খেলে, তাই না? রোজ বাড়িতে খায় সবাই। একদিন একটু ফুর্তি করার জন্য খাবারদাবার নিয়ে বাগানে আসে। বনভোজন করতে। আসে ছেলেমেয়ে নিয়ে। চেয়ে দেখো, কেউ এসে মাঠের মধ্যিখানে বসে না। বসে মাঠের ধারে, গাছের তলায়। কারণ, সেখানটাই একটু ঠান্ডা। এভাবে সবার কাজে লাগতে পারলে জীবনের একটা মানে হয়। তাই না?' একসঙ্গে অনেক কথা বলে ঋষি চুপ করল।
যারা বেড়াতে আসে তাদের সবাইকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু সবচেয়ে ভালোবাসি বুড়োবুড়িদের। আর বাচ্চাদের। বুড়োবুড়িরা ঠান্ডা ছায়ায় কেমন চুপচাপ বসে থাকে। বেশি নড়াচড়া করে না। কথা বলে আন্তে আস্তে-যেন ফিসফিস করো
ছোট ছেলেমেয়েদেরও আমি পছন্দ করি। কিন্তু তারা একটু দুরন্ত হয়। কেউ কেউ আমার মা-গাছকে আঘাত করে। কেউ কেউ গাছের বাঁকলে নিজেদের নাম লেখে। কেউ আবার আমাদেরই ছিঁড়ে নেয়। আমার সাথিদের ছিঁড়তে দেখে আমার কষ্ট হয়, বেচারাদের জন্য কান্না পায়। কিন্তু তবু ছোটদের হৈচৈ করে খেলতে দেখে আমার ভালো লাগে। সেদিন দুটো ছেলেমেয়ে এসেছিল তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে। কী মিষ্টি চেহারা তাদের!
এভাবে দেখতে দেখতে গরমের সময়টা আমার চলে গেল।
তারপর এলো হেমন্ত। কার্তিকের রাতে কেমন শীত শীত করতে শুরু করল। অয়ানের শুরুতে এক রাতে সত্যি খুব ঠান্ডা লাগল। রাতের বেলা শীতে ঠক ঠক করে কাঁপছিলাম। মনে হচ্ছিল শরীরটা কে যেন ভিজিয়ে দিচ্ছে। পরের দিন ভোরের আলোতে দেখলাম, আমার গায়ে কী যেন সাদা সাদা লেগে আছে। অন্যদের দিকে চেয়ে দেখলাম, তাদের গাও সাদা সাদা। ঋষিকে জিগগেস করলাম, 'এটা কী, ভাই?' সে বলল, 'রাতের বেলা হিম পড়েছিল।' 'হিম? হিম কী?' আমি আবার জিগগেস করলাম। সে বুঝিয়ে বলল-বেশি ঠান্ডা পড়লে বাতাসে যে বাষ্প থাকে, তা-ই জমে গিয়ে নাকি হিম পড়ে। 'বুঝলে, কিশলয়। হিম থেকে বোঝা যাচ্ছে শীতকাল এসে গেছে। দেখবে কী রকম শীত পড়ে। আর চারদিকটাই ঢেকে যাবে সাদা বরফে। মনে হবে যেন কে সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে দিয়েছে!' ঋষি বলল, সবজান্তার মতো।
হিম পড়ার পর কদিন কেটে গেছে। একদিন বিকেলে এদিকে-ওদিকে চেয়ে দেখলাম। কেমন যেন মনে হলো। মনে হলো সমস্ত বাগানটার রং বদলে যাচ্ছে। হয়তো আগে থেকেই রং বদল শুরু হয়েছে। কিন্তু আমার চোখে পড়েনি। অল্প দিন আগেও চারদিকটা কেমন সবুজে ছেয়ে ছিল। মনে হতো যেন সবুজের বান ডেকেছে বাগানে, মাঠে, গাছগুলোর ওধারের দিঘিতে, এমনকি আকাশের কানায় কানায়। সেই সবুজ যেন কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে। তার বদলে এ কী রঙের খেলা শুরু হলো পাতায় পাতায় ।
মনে হলো, সমস্ত পার্কে রঙের আগুন লেগেছে। আমার বন্ধু আলোর দিকে চেয়ে দেখলাম, তাকে চেনা যাচ্ছে না। সবুজের বদলে তার রং হয়েছে গাঢ় হলুদ। বেণুর রং হয়েছে আরও বাহারে। উজ্জ্বল কমলা রং। পর্ণার গায়ে যেন আবির মেখে লালের আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। কখন যে আমিও হলুদ আর কমলা মেশানো একটা অদ্ভুত রঙে নেয়ে উঠেছি খেয়ালই করিনি। ভাবলাম, কোনো এক অজানা জাদুতে সবারই রং পাল্টে গেছে। ঋষি! ঋষির রংটা দেখতে হয়! দেখলাম, তার গায়ে লেগেছে বেগুনির ছাপ। আশ্চর্য! মনে হলো আমরা সবাই মিলে আকাশের রংধনুর রঙে স্নান করে উঠেছি।
আমরা তো সবাই একই মায়ের সন্তান। তা হলে এমন বিচিত্র রং হলো কেন আমাদের? ঋষিকেই জিগগেস করলাম। সে বিজ্ঞের মতো উত্তর দিল: 'হই, আমরা একই গাছের পাতা। কিন্তু আমরা সবাই আলাদা। আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতাও আলাদা। সূর্যের আলো আমাদের ওপরে পড়েছে এক-একভাবে। ছায়া পড়েছে এক-এক রকম। তা হলে বলো, আমাদের রং এক-এক রকম হবে না কেনা' ঋষি আবার বলল, 'জানো, এই রঙের মরসুমকে কী বলে? একে বলে হেমন্ত। ঝরে যাওয়ার কালা' কষির কথা শুনে কী এক অজানা ভয়ে মনটা দুলে উঠল।
এরই মধ্যে একদিন ভারি অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। সেই ছেলেবেলা থেকে হাওয়ার সঙ্গে নেচে নেচে বড়ো হয়েছি। হাওয়াকে চিরদিন দেখেছি, কী প্রসন্ন। রাগ দেখিনি কখনো। তাকে ডেকেছি মিতা বলে। সেই হাওয়াই একদিন এলো কী প্রচন্ড রাগী চেহারায়া এত দিন তার ঘাড়ে চড়ে খেলেছি। আজ মনে হলো, বোঁটা থেকে সে আমাদের ছিঁড়ে নেবে। আছাড় দিয়ে ছুড়ে ফেলবে। সত্যি সত্যি বাতাসের তোড়ে কেউ কেউ ছিঁড়ে গেল গাছের ডাল থেকে। কেউ বা কোথায় উড়ে গেল তার খবরও জানি না। একটা ডাল ভেঙে গেল পাশের গাছটার। সত্যি আমরা পাতারা সবাই ভয় পেয়ে কাঁপতে থাকলাম। আমরা একে অন্যকে ফিসফিস করে জিগগেস করলাম, 'এটা কী হচ্ছে?'
সবজান্তা ঋষি উত্তর দিল। বলল, 'তোমরা জানো না, কিন্তু হেমন্তের প্রথম দিকে এটা হয়েই থাকে। এ হলো পাতাদের বাসা বদলের সময়। এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় চলে যাওয়ার সময়। লোকেরা একে বলে মরে যাওয়া, এক কথায় মৃত্যু।'
আমি সহজেই ভয় পাই। ঋষিকে জিগগেস করলাম, ‘আমরা কি সবাই মরে যাব?’
'হ্যাঁ, আমরা সবাই-সবাই মরে যাব। সবাই মরে যায়। বড়ো-ছোটো, দুর্বল-সবল-কেউই চিরদিন বেঁচে থাকে না। আমরা মরে যাব।' আমার মলিন মুখ দেখে ঋষি একটু থেমে গেল। তারপর আবার বলল, ‘দেখো, কিশলয়, আমরা সবাই আসি একটা কাজ নিয়ে। একটা ভূমিকা পালন করতে। সূর্যের আলোতে আমরা বেড়ে উঠি, চাঁদের আলো গায়ে মাখি, হাওয়ার সঙ্গে নাচি, বৃষ্টিতে স্নান করি। আমরা নাচতে শিখি, গাইতে শিখি, হাসতে শিখি। কখনো কখনো কাঁদিও। কিন্তু আমাদের কাজ শেষ হলে আমরা চলে যাই। আমরা মরে যাই।’
ঋষির সব কথাই আমি নীরবে মেনে নিয়েছি। কোনো প্রতিবাদ করিনি। কিন্তু আজ পারলাম না। প্রায় প্রতিবাদের সুরে গলায় জোর এনে বললাম, 'আমি মরব না।' তারপর থেমে আবার বললাম, ‘ঋষি, তুমি কি মরবে?’
ঋষির মুখের একটি পেশিও নড়লো না। অবলীলায় বলল, ‘হ্যাঁ, আমি মরব তো! আমার যখন সময় হবে, তখন আমি মরে যাব।’
'সময়! কখন সময় হবে?'-আমি জিগগেস করলাম।
ঋষি বলল, ‘সেটা কেউই ঠিক করে জানে না।’
আমি ভাবলাম, ঋষি নিশ্চয় ভুল বলেছে। এই যে আমি, বেঁচে আছি, ভাবছি, ভালোবাসছি, কল্পনা করছি-এই আমি কি মরতে পারি? কক্ষনো না।
কিন্তু দিন যায়। আমি লক্ষ করি, আরও পাতা ঝরে পড়ছে। মা-গাছের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে। তা হলে, ঋষিই কি ঠিক বলেছে? তা হলে এদের কি সময় হয়ে গেছে?
আমি লক্ষ করলাম, কোনো কোনো পাতা ঝরে পড়ার আগে প্রাণপণ গাছটাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। হাওয়াকে ফাঁকি দিতে চায়। আবার কেউ কেউ হাওয়ায় চড়ে মৃত্যুর রথ এলে নিজের বাঁধনটাকে ছেড়ে দেয়। তারপর ঝরে পড়ে নীরবে, শান্তভাবে।
দিন থেমে থাকে না। তারই মধ্যে একদিন আমি চারদিকটা চেয়ে দেখি। দেখলাম, গাছের ডালগুলো প্রায় শূন্য হয়ে গেছে। একদিন ঋষিকে বললাম, 'ঋষি, তুমিই বোধহয় ঠিক। হয়তো মরতেই হবে। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে। আমি জানি না নিচে, গভীরে কী আছে। মনে হয়, সেখানে আছে এক রাশ জমাট-বাঁধা অন্ধকার।'
শান্ত কণ্ঠে ঋষি বলল, 'দেখো, কিশলয়, আমরা যা জানি না, তাকে আমরা সবাই ভয় পাই।' 'কিন্তু বসন্ত গিয়ে যখন গরমের সময় এলো, তখন তো আমরা ভয় পাইনি। গরমের সময় গিয়ে যখন হেমন্ত এলো তখনো তো ভয় পাইনি। এই পরিবর্তনই স্বাভাবিক। তা হলে মৃত্যুর ঋতু দেখে ভয় পাব কেন?'
আমাদের মা-গাছ? সেও কি মরে যাবে?'
'হ্যাঁ, একদিন সেও মরে যাবে। কিন্তু সে কথা থাক। মনে রেখো, এ গাছের থেকেও শক্তিশালী একটা জিনিস আছে। সে হলো জীবন। জীবনের কোনো শেষ নেই। আমরা সেই অন্তহীন জীবনের অংশ।'-ঋষি বুঝিয়ে বলল।
'আমরা কি আবার ফিরে আসব? আগামী বসন্তে?'
না, আমরা বোধহয় ফিরব না। কিন্তু জীবন থেমে যাবে না। জীবন আবার ফিরে আসবে।'
আমার মন তবু তৃপ্তি পায় না, সাত্বনা পায় না। আবার বলি, 'তাহলে এই যে এলাম, এই যে বড়ো হলাম, হাসিকান্নায় এত দিন বেঁচে থাকলাম, এর মানে কী?' একটু থেমে আবার ভেবে বললাম, 'যদি করেই যাব, যদি বিদায় নিতেই হবে, তাহলে এসেছিলাম কেন?'
কোনো আবেগ দেখাল না ঋষি। বলল, ‘এটাই জীবন। এই যে সূর্যের আলোতে বেঁচে থাকলাম, এই যে চাঁদের আলোর স্নেহশীতল স্পর্শ পেলাম, এই তো জীবন! একসঙ্গে আনন্দের সময় কাটিয়েছি আমরা। ছায়া দিয়েছি। বুড়োবুড়ি আর শিশুদের দেখেছি-সেবা করেছি। হেমন্তে রঙের খেলা দেখেছি। দেখেছি ঋতুবদলের পালা। এই কি যথেষ্ট নয়? এই তো জীবন!’
সেদিন গোধুলি আলোয় হাওয়ার রথ এলো। ঋষি তাতে চেপে বসল। মনে হলো, পড়ে যেতে যেতেও সে শান্ত হাসিতে উদ্ভাসিত। দূরে যেতে যেতে আমাকে বলল, ‘কিশলয়, এখনকার মতো বিদায়, ভাই!’
ডালটায় আর কেউ বাকি নেই। শুধু আমি। একা। কোথায় গেল আলো, বেণু, পর্ণা। খেয়াল করিনি তো। কোথায় গেল আমার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু-ঋষি। আমি বেঁচে আছি। কিন্তু নিঃসঙ্গ।
পরের দিন মরসুমের প্রথম বরফ পড়ল। পেঁজা তুলোর মতো। সুন্দর। কোনো ভার নেই তার কিন্তু ভারি ঠান্ডা। সেই সঙ্গে কনকনে উত্তুরে হাওয়া। সূর্যের আলো দেখা গেল না প্রায় সারা দিন। দিনটা কেটে গেল দেখতে দেখতেই। মনে হলো, আমার যেটুকু রং বাকি ছিল, তাও যেন হারিয়ে গেল। ডালটাকে ধরে রাখার শক্তি আমার যেন লোপ পাচ্ছে। তারই মধ্যে বরফ পড়ছে নিঃশব্দে। রাতের নীরব অন্ধকারে অজানা কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। সেই সঙ্গে আমার ওপর বরফ জমে উঠছে ধীরে ধীরে।
ভোরবেলাতে একটা হাওয়া এলো। সেই সঙ্গে যেন এলো অজানার আহ্বান। আমি ডালটাকে ছেড়ে দিলাম। একটুও লাগল না আমার। আমি যেন ভেসে চলেছি নিচের দিকে, খুব ধীরে। তারপর মাটিতে পড়ে প্রথমবারের মতো দেখতে পেলাম পুরো গাছটাকে। কী বিশাল! কী দৃঢ়। নিশ্চিত জানি, আমি বিদায় নিলেও এ গাছ বেঁচে থাকবে বহুকাল। জানি আমিও জীবনের অংশ ছিলাম। ভাবতেও আমার গর্ব হচ্ছে-আমি জীবনের অংশ ছিলাম। জীবনের ধন কিছুই বিফলে যায়নি। কিছুই বিফলে যাবে না।
আমি পড়লাম, তুলোর মতো নরম এক ভাল বরফের ওপর। মনে হলো, সে বরফ নিষ্প্রাণ শীতল নয়। তার ভেতর প্রাণের উষ্ণতা টের পেলাম যেন। আমি বড্ড ক্লান্ত। চোখ খুলে রাখতে পারছি না। ঘুম পাচ্ছে আমার।
কিশলয় সত্যি ঘুমিয়ে পড়ল।
কিশলয় জানত না, শীতের পরে আবার বসন্ত আসবে। জানত না, চিরদিন বরফ থাকবে না। বরফ গলে গিয়ে জল হবে। সে জানত না, সেই জলে মিশে তার শুকনো দেহটা মা-গাছের শেকড়ে গিয়ে আবার গাছে মিশে যাবে। জানত না, তার দেহটা বিফলে যাবে না। গাছটা আরও জোরালো হয়ে উঠবে। যা একদমই জানত না কিশলয়, সে হলো: গাছ আর মাটিতে মিলে এরই মধ্যে ঠিক করে ফেলেছে নতুন ফাল্গুনে আরেক রাশ পাতা আসবে গাছে।
কিশলয়ের জন্ম মৃত্যু' রচনার ভিত্তিতে নিচে কয়েকটি প্রশ্ন দেওয়া আছে। তোমার একজন সহপাঠীর সাথে এগুলো নিয়ে আলোচনা করো এবং সংক্ষেপে উত্তর তৈরি করো।
ক. লেখক এই রচনায় প্রকৃতির পালাবদলের কেমন ছবি এঁকেছেন?
________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
খ. মানুষের জীবনের সাথে গাছের পাতার মিল কোথায়?
________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
গ. এই রচনায় জীবন সম্পর্কে লেখকের কোন মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে?
________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
'কিশলয়ের জন্ম মৃত্যু' রচনাটির যেসব বক্তব্য নিয়ে তোমার মতামত রয়েছে বা মনে প্রশ্ন জেগেছে, তা নিচের ছকে লেখো। কাজ শেষে কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে উত্তর মেলাও এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো। একটি নমুনা দেওয়া হলো।
'কিশলয়ের জন্ম মৃত্যু' শিরোনামের রচনাটিকে কেন কল্পনানির্ভর লেখা বলা যায়? উদাহরণ দিয়ে বোঝাও।
___________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________
কল্পনানির্ভর লেখা
চারপাশের যে জগৎ আমরা দেখতে পাই, তাকে বলে বাস্তব জগৎ। কল্পনানির্ভর রচনায় থাকে কাল্পনিক ও অবাস্তব ঘটনা কিংবা চরিত্র। বিভিন্ন ধরনের কল্পনানির্ভর রচনা রয়েছে:
রুপকথা: এ ধরনের রচনায় রাজা, রানি, দৈত্য-দানব ইত্যাদি থাকে। এসব গল্প সাধারণত মানুষের মুখে মুখে চলতে থাকে এবং একটি গল্পের কাঠামো পায়।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি: এ ধরনের রচনায় ভবিষ্যতের জগৎ, বিজ্ঞানের অনাবিষ্কৃত এলাকা, গ্রহান্তরের কাল্পনিক ধারণা ইত্যাদি যুক্ত থাকে।
রম্যরচনা: এ ধরনের রচনায় লেখক সরস ভঙ্গিতে কোনো বক্তব্য বা কাহিনি তুলে ধরেন। অনেক সময়ে কৌতুক-হাস্যরস, কিংবা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ব্যবহার করে এ ধরনের লেখাকে আকর্ষণীয় করা হয়ে থাকে।
এছাড়া অতিকল্পনা রয়েছে এমন গল্প-উপন্যাসকেও কল্পনানির্ভর রচনা হিসেবে গণ্য করা হয়। 'কিশলয়ের জন্ম- মৃত্যু' এ ধরনের একটি কল্পনানির্ভর রচনা।
Read more